রূপগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ ০৩:১৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জীবন আলী

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত : ০২:১০:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর ২০২৩
  • ৯০ বার দেখা হয়েছে

আমাদের জাহাজে সদ্য জয়েন করা এক নবীন ইঞ্জিন ক্রু। জাহাজের ভাষায় আমরা একে ‘ওয়াইপার’ (Wiper) বা ‘ফায়ারম্যান’ ( Fireman) বলি। নাটোরের এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেয়া জীবন আলী বাংলাদশের হাজারো অল্প শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত তরুণদেরই একজন। হত-দরিদ্র বাবা-মার ঘরে জন্ম নেয়া, সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই তরুণরা জীবনকে বুঝার আগেই জীবনের দায় মেটাতে একটা কাজ খুঁজে পেতে হন্যে হয়ে উঠে।

জীবন আলীও কারো কাছ থেকে শুনে অথবা গ্রামে ঘুরে বেড়ানো দালালের আকাশচুম্বী প্রলোভনে পড়ে

জাহাজে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু জাহাজে চাকরি করার জন্য প্রাথমিক প্রক্রিয়াটা খুবই দীর্ঘ আর জটিল। সাধারণ ক্রু হিসেবে জয়েন করার জন্যেও তাদেরকে সরকার অনুমোদিত কোনো মেরিন অ্যাকাডেমি থেকে কমপক্ষে ছয় মাসের ট্রেনিং নিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের আর সব প্রতিষ্ঠানের মতো এই সব বেসরকারি মেরিন অ্যাকাডেমিগুলোও ট্রেনিং এর চাইতে সহজ-সরল তরুণদের স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ট্রেডিং করতেই বেশি ব্যস্ত।
কোভিড মহামরি শুরু হওয়ায় আগে আগে জীবন আলীও এক দালালের মাধ্যমে বাবার শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে পাঁচ লাখ পনের হাজার টাকা জমা দিয়েছিল এক বেসরকারি মেরিন অ্যাকাডেমি বরাবর। ভর্তি হতে এসে দেখে তার নামে আড়াই লাখ টাকা জমা করা হয়েছে। বাকিটা দালাল মেরে দিয়েছে। এলাকায় বহু দেনদরবার করার পর দালাল আরও এক লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে। ভাগ্য ভালো যে দালাল বেটা যুবক, ডেস্টিনি, ইউনিপে টু, বা শেয়ার বাজারের মতো পুরোটা মেরে হাওয়া হয়ে যায়নি। কিন্তু পুরো টাকা জমা না দিলে আ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়া যাবে না। এবার এক চাচার মাধ্যেমে ব্রাক থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা হলো।

বিক্রিযোগ্য সব কিছু শেষ করে ঋণের বোঝায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হলেও ট্রেনিং আর নেয়া হয়নি, কারণ ততদিনে কোভিডের কারণে আ্যাকাডেমি বন্ধ। থাকা খাওয়া ট্রেনিং সব ওই টাকার মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র এক মাসের মাথায় জীবন আলীকেও বাড়ি ফিরতে হয়েছে অন্যান্য অনেকের মতো। বলা হয়েছে কোভিড শেষ হলে এসে যাতে সার্টিফিকেট নিয়ে যায়। এদিকে কোভিডও শেষ হয় না, জীবন আলীর সার্টিফিকেট আর অন্যান্য ডকুমেন্টও (পাসপোর্ট, সিডিসি, এসআইডি) পাওয়া হয় না। বাবা মানুষের জমিতে কাজ করে আর ইন্টার পাশ করা জীবন আলী রাজ মিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করে যা উপার্জন করেছে তা দিয়ে পাঁচজনের সংসার কীভাবে চলেছে আর কীভাবে ব্র্যাকের টাকার কিস্তি পরিশোধ করেছে হয়তো আমরা অনেকেই অনুমান করতে পারছি। তাই সেই বিশদ বর্ণনা আপাতত তোলাই থাকুক।

গত বছর জুন মাসে ওর সিডিসি বা সিম্যান বুক ইস্যু হয়। সিডিসি, পাসপোর্ট, এসআইডি, মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট আর নাবিকদের জন্য ম্যান্ডেটরি প্রাথমিক ছয়টা Ancillary course সার্টিফিকেট পেতে লেগে যায় আরও প্রায় এক লাখ টাকা। এই টাকা কিভাবে যোগাড় হয়েছে সেটা জানার সাহস আমার হয়নি।

সব ডকুমেন্ট হাতে পাওয়ার পর জীবন আলীও স্বপ্ন দেখতে থাকে একদিন জাহাজে যাওয়ার ডাক আসবে। (উল্লেখ্য যে ট্রেনিং অ্যাকাডেমিগুলোই এসব ক্রুকে জাহাজে চাকরি দেয়ার ব্যাপারে কমিডেট থাকে) কিন্তু নাটোর থেকে চট্টগ্রামে এসে আ্যাকাডেমির সাহেবদেরকে অনুরোধ করার জন্য গাড়ি ভাড়াটা যোগাড় করাও হয়ে উঠে না জীবন আলীর, আর তাই কোন জাহাজের ক্রু তালিকায় তার নামও উঠে না।

এ বছর এপ্রিল মাসে জীবন আলী একটু আলোর দেখা পায় যখন সে জানতে পারে তাকে একটা জাহাজের জন্য সিলেক্ট করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগাদের সাথে ভাগ্যও মনে হয় মাঝে মাঝে নির্মম নাটক করে। জীবন আলীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটল।

এই অশ্রুতপূর্ব, অদৃষ্টপূর্ব ঘটনা আমার দীর্ঘ নাবিক জীবনে আমি দেখিনি, শুনিওনি, সেটা বলার জন্যই এই দীর্ঘ গৌড়চন্দ্রিকা।

জয়েনিং ক্রু লিস্ট যখন আমার হাতে আসলো দেখি সেই তালিকায় জীবন আলী আর কাবিল হোসেন; এই দুটি নাম আছে। অর্থাৎ জীবন আলী আর আমি একই জাহাজে যাচ্ছি। একটু অপ্রচলিত নাম বলেই ওই নামগুলোর দিকে চোখ গিয়েছিল সে সময়। এর বেশি গুরুত্ব পাওয়ার মতো কিছুই ছিল না। যে ৭ জন আমরা জয়েন করতে যাচ্ছিলাম তার মধ্যে শুধু চিফ ইঞ্জিনিয়ার আর থার্ড ইঞ্জিয়ার আমার পূর্ব পরিচিত।আর কাউকেই আমি তখন চিনতাম না।

জীবন আলী

বাংলাদেশের পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন লেখক আলমগীর কবির। লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া ছবি।

এপ্রিল মাসের ৬ তারিখে আমার আগেই সবাই বিমানবন্দরে উপস্থিত। আমিও গিয়ে সবার সাথে পরিচিত হলাম। সবার ট্রাভেল ডকুমেন্টস আর সিম্যান ডকুমেন্ট এর কথা জিজ্ঞেস করতেই বোসান (হেড অব ডেক ক্রু) বলল, স্যার, ম্যানিং এজেন্সি জীবন আলীর পাসপোর্টের জায়গায় অন্য আরেকজনের পাসপোর্ট আমাকে অন্যান্য ডকুমেন্টের সাথে একই প্যাকেটে দিয়ে দিয়েছে। এখানে এসে প্যাকেট খুলে দেখি জীবন আলীর পাসপোর্টের বদলে আরেক জনের পাসপোর্ট আছে প্যাকেটে!

এই অদ্ভুতুরে কাণ্ডকীর্তি আগে কখনো দেখিনি। (এখানে বলে রাখা ভালো যে সিম্যানদের জয়েনিং কনফার্ম হলে কিছু কিছু ম্যানিং কোম্পানি দু-একটা গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ওদের কাছে রেখে দেয় যাতে সিম্যান অন্য কোনো কোম্পানিতে চলে যেতে না পারে। জীবন আলী যে কোম্পানিতে ট্রেনিং করেছে, ম্যানিং এজেন্সিও সেই একই কোম্পানির। তাই ওর প্রায় সব ডকুমেন্টস ওদের কাছেই ছিল)। কিছুটা সময় স্তম্ভিত হয়ে থেকে ফোন করলাম ম্যানিং এজেন্সি অফিসে। এটা যে বড়সড় কোনো ভুল তাদের কথায় সেরকম মনেই হলো না।

বলল, ছোট একটা ভুল হয়ে গেছে স্যার। আপনি ভুল পাসপোর্টটা সহ ওকে বাড়িতে চলে যেতে বলেন, আমরা পরবর্তী সুবিধাজনক সিডিউলে ওকে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। বুঝতে পারলাম জীবন আলীর আর ব্রাজিল যাওয়া হচ্ছে না। পরবর্তী সিডিউল স্রেফ ছেলে ভোলানো সান্তনা। কারণ আমাদের যাওয়া আর সাইন অফ ক্রুদের ফিরে আসার জন্য সময় আছে মাত্র চারদিন।

জীবন আলী জয়েন করলে আবদুল কাইয়ুমের দেশে আসার কথা, সেটাও অনিশ্চিত হয়ে গেল অনিশ্চিত সময়ের জন্য। অথচ কাইয়ুমের ততদিনে ৯ মাসের বেশি হয়ে গেছে জাহাজে। নাবিকদের ভ্রমনের জন্য ভিসা না লাগলেও বাংলাদেশি ক্রুদের জন্য অনেক দেশই লেটার অব গ্যারান্টি ইস্যু করে না। কারণ আমাদের জাতিগত ইতিহাস এতই সমৃদ্ধ যে বাংলাদেশের কথা শুনলেই অনেক দেশ চ্যাপ্টার ক্লোজ করে বসে থাকে।

জাহাজ কোন দেশের কোন পোর্টে যাবে সেটা আগে থেকে জানার সুযোগ নেই। জানা গেলেও সব দেশে

বাংলাদেশের ক্রু চেঞ্জ করায় অসংখ্য বাধা নিষেধ আছে। অর্থাৎ Convenient Port না পেলে ক্রু চেঞ্জ করা যায় না। জীবন আলীর বিষয়টাও ধামাচাপা পড়ে গেল সম্ভাবনা আর গাফিলতির লাল ফিতায়। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো আবদুল কাইয়ুমকে নিয়ে। তার রিলিভার যেহেতু আসতে পারে নাই তাই কাইয়ুমেরও

সাইন অফ হয়নি ব্রাজিল থেকে।
জীবন আলী

জাহাজে সহকর্মীদের সঙ্গে আলমগীর কবির। লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া ছবি।

মাঝে দুই মাসের বেশি পার হয়ে গেল সাইন অন/অফ করার মতো কোনো পোর্ট পাওয়া গেল না। অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতোই অপারেশন্স ডিপার্টমেন্ট জানালো জাহাজের নেক্সট পোর্ট সিংগাপুর হয়ে চায়নার চিংদাও (Qingdao)। আবদুল কাইয়ুম আর ডেক ক্যাডেট সাইন অফ লেটার দিল। সিংগাপুর যেতে যেতে দুইজনেরই ১২ মাসের বেশি ভয়েজ হয়ে যাবে।

সিংগাপুরে বাংলাদেশি ক্রুদের সাইন অন/অফে ভিসা নিতে হয়। এজেন্টের মাধ্যমে ভিসার আবেদন করলে প্রায় সব ক্রুর জন্যই ভিসা পাওয়া যায়। সিংগাপুরে পৌঁছার আগেই ডেক ক্যাডেটের ভিসা কপি জাহাজে চলে আসলেও কাইয়ুমের ভিসার কোনো খবর নাই।

এদিকে কাইয়ুম দিনে তিন চার বার এসে জানতে চায় তার ভিসার কোনো খবর আছে কিনা। অনলাইনে তার ভিসা এপ্লিকেশন পেন্ডিং দেখাচ্ছে। সিংগাপুর পৌঁছার দুই দিন আগে ম্যানিং অফিসে ফোন দিলাম কাইয়ুমের ভিসার ব্যাপারে। যা জানলাম তাতে মেজাজ ধরে রাখা খুবই কঠিন হয়ে গেল।

ম্যানিং অফিসে রাখা কাইয়ুমের পুরাতন পাসপোর্টের নম্বর দিয়েই ভিসার এপ্লিকেশন করা হয়েছে। অথচ আমি যে ক্রু লিস্ট ইমিগ্রেশনে জাহাজ থেকে পাঠিয়েছি তাতে নতুন পাসপোর্টের তথ্য। পাঁচ বছর মেয়াদি মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট বদলিয়ে কাইয়ুম ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট করে জাহাজে এসেছে। পুরোনো পাসপোর্ট ম্যানিং এজেন্সির অফিসেই ছিল। আর আহাম্মকের দল সেই পাসপোর্টের তথ্য দিয়েই ভিসা আবেদন করেছে।

আমাকে আবার উলটো রিকোয়েস্ট করলো আমি যাতে কাইয়ুমের পুরোনো পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে আরেকটা ক্রু লিস্ট ডিক্লেয়ার করি!

আমি শুধু বললাম, আমাকে কি তোমার কাছে পাগল বা গাঁজাখোর বলে মনে হয়??

-স্যরি স্যার, আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না বলেই এই রিকোস্টটা করলাম।

নিজেকে কোনো রকম সংযত করে বললাম, যা বলেছ, তা আর ভবিষ্যতে কখনো মুখেও আনবে না। একজন ক্রুর জন্য আমি গোটা বাংলাদেশি ক্রু আর আমার জাহাজের ২২ জন ক্রু কে সারাজীবনের জন্য সিংগাপুরে ব্লাক লিস্টেড করতে পারি না।

-স্যরি স্যার।

কিন্তু শুধু সরি বলাতেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। অন সাইনার (On Signer) ডেক ক্যাডেট আর জীবন আলীর ভিসা হলেও জীবন আলী আসতে পারলো না কারণ তার রিলিভার কাইয়ুমের ভিসা এপ্লিকেশন রিজেক্ট হয়েছে।

এবার কাইয়ুম এসে উৎপাত শুরু করল। কান্নাকাটি চেঁচামেচি করে ডিউটিতে যাওয়া বন্ধ করে দিল। ওকে বুঝালাম, ওর ভিসা না হওয়ার জন্য আমরা দায়ী নই। ভুলটা করেছে ম্যানিং এজেন্সি, তুমি জাহাজে অশান্তি করলে তো কারও কোনো লাভ হবে না।

চায়নার চিংদাওতে তোমাকে নামানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করব। ভালো ছেলে, কথা শুনলো। একদিন পর কাজেও যোগ দিল। কথা বললাম (জাহাজ মালিকের) হেড অফিসের সাথে। ওরা খবর নিয়ে জানালো চায়নার ভিসা আবেদন অনেক দিন আগে করতে হয়। তাছাড়া এত আবেদন পেন্ডিং হয়ে আছে যে আবেদন করলেও এক মাসের আগে কিছুই জানা যাবে না।

অনন্যোপায় হয়ে চায়নার এজেন্টের সাথে কথা বললাম। এজেন্ট জানালো ভিসা ছাড়াও সাইন অফসম্ভব। তবে সেটা লোকাল এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি চায়নার বাইরে যে কোনো দেশে চলে যেতে হবে। চায়নার ভিতরে কোনো কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে হলে তাকে ভিসা নিতেই হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, চিংদাও এয়ারপোর্ট থেকে কোন ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট নাই। ভিসা এপ্লিকেশন প্রসেস করতে যে সময় লাগে তার অনেক আগেই তুমি পোর্ট ছেড়ে চলে যাবে। স্যরি ক্যাপ্টেন। এখানেও স্যরি। কিন্ত আমি শুধু স্যরি বলে কাইয়ুমকে কিছু বুঝাতে পারছি না। ২১-২২ বছরের বাচ্চা একটা ছেলে। ১৩ মাস এক নাগাড়ে জাহাজে। এটাই ওর প্রথম ভয়েজ। যুক্তি আর বাস্তবতা বুঝার মতো বয়স বা মানসিক অবস্থা কোনটাই ওর নাই।

ওদিকে জীবন আলী সব খুইয়ে বসে আছে জাহাজে আসার জন্য এদিকে আবদুল কাইয়ুম সব কিছু দিয়ে হলেও জাহাজ থেকে নেমে যেতে চাইছে।

চায়নার পালা শেষ করে জাহাজ আবার রওনা হলো সিংগাপুরের দিকে। এবার কাইয়ুম সহ আরও তিনজন সাইন অফ রিকোয়েস্ট লেটার দিল। যথারীতি সবার জন্যই সিংগাপুরের ভিসা আবেদন করা হলো। যারা আসবে এবং যাবে সবার ভিসা হলেও কাইয়ুমের ভিসা এপ্লিকেশন আবারও রিজেক্ট হলো। যদিও এবার নতুন পাসপোর্ট দিয়ে জাহাজ থেকেই সব তথ্য দেয়া হয়েছিল। কারণ হিসাবে জানা গেল মাত্র একমাস আগেই ভিন্ন পাসপোর্ট নম্বরে এপ্লিকেশন করে জাহাজে থেকেই নতুন পাসপোর্ট কিভাবে পেল। এটা সন্দেহজনক এবং সরাসরি রিজেক্টেড।

জীবন আলী

কাজের ফাঁকে সেলফিতে লেখক। লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া ছবি।

বাকি তিনজন চলে গেল, দেশ থেকে তিনজন জাহাজেও আসলো। কিন্তু কাইয়ুমের যাওয়া হলো না আর জীবন আলীরও আসা হলো না। যদিও জীবন আলীর ভিসা প্রথমবারই হয়েছিল। কাইয়ুমকে সান্তনা বা আশা দেয়ার মতো আমার হাতে কিছুই থাকলো না। কারণ জাহাজের ডেস্টিনেশন ইন্ডিয়ার গুজরাট। গুজরাট থেকে সাইন অফ তো দূরের কথা বাংলাদেশিদের হাঁটার জন্য বাইরে যাওয়ারও অনুমতি নাই। এমনকি মাত্র ত্রিশ দিন মেয়াদি লোকাল সিমকার্ড কেনাতেও বাংলাদেশিদের জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা।

ওরা আমাদের প্রাণের বন্ধু না? নিষেধাজ্ঞাতো ওরাই দেবে, তাই না?

সিংগাপুরে জাহাজ অবস্থান করে সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা। কারণ জ্বালানি তেল বা বাংকার নেয়ার জন্যই মূলত সিংগাপুরে থামা হয়। এর মধ্যেই সিংগাপুর ইমিগ্রেশন বরাবর পূর্বাপর সব ঘটনা জানিয়ে মানবিক কারণে জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে কাইয়ুমের ভিসা মঞ্জুর করার জন্য বিশাল সাইজের একটা এপ্লিকেশন পাঠালাম। পরামর্শটা অবশ্য সিংগাপুর এজেন্টই দিয়েছিল। কিন্তু সময়ের অভাবে সেই এপ্লিকেশনের ভাগ্য জানার সুযোগ ছিল না। মজার বিষয় হলো, সিংগাপুর থেকে সেইল করার দুদিন পর এজেন্ট মেইল দিয়ে জানালো ক্যাপ্টেনের এপ্লিকেশন ওরা বিবেচনা করেছে, কাইয়ুমকে ভিসা দিতে সম্মত হয়েছে যদি ইতিমধ্যে জাহাজ সেইল করে চলে না গিয়ে থাকে।

ভাগ্যকে দোষারোপ করা ছাড়া আমাদের করার আর কিছুই ছিল না। কাইয়ুম চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে সরাসরি বলে দিল, সে পানিতে ঝাঁপ দেবে আর এর জন্য আমরাই দায়ী থাকব।

কাজতো অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে, পাগলামিও শুরু করলো যথেচ্ছ। কাইয়ুমের হুমকিকে পাগলামির বহিঃপ্রকাশ মনে হতে পারে। কিন্তু ধৈর্য হারা সিম্যানদের পক্ষে এসব শুধু কথার কথা নয়। অবাস্তবও নয়। টপ আর্জেন্ট ক্যাটাগরিতে মেইল দিলাম সব পক্ষকে। এবং পরিষ্কার করে বলে দিলাম ওর পক্ষ থেকে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জাহাজের মাস্টার বা কোনো ক্রু কোনোভাবেই দায়ী থাকবে না। আপনাদের ঠেলা আপনারা সামলান।

পরামর্শ হিসাবে বললাম, জাহাজ যেহেতু শ্রীলংকার পাশ দিয়েই যাবে সুতরাং গলে তে (Galle) ওকে

সহজেই নামানো যায়। এটাও জানালাম কাইয়ুমকে রিলিভার ছাড়া নামিয়ে নিলেও সেইফ ম্যানিং এর কোনো সমস্যা হবে না। (একটা জাহাজ সেইফলি চালানোর জন্য মোট কতজন সার্টিফাইড ক্রু লাগবে, তার

জন্য একটা সার্টিফিকেট লাগে, যাকে সেইফ ম্যানিং সার্টিফিকেট বলে) ইন্ডিয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।
এবার সবাই নড়েচড়ে বসলো। কর্তাব্যক্তিরা সবাই সরাসরি ওকেই ফোন করতে লাগলো। তেলতেলে কথাবার্তাও অনেক শোনাল। কিন্তু সহজ সরল মানুষ ক্ষেপে গেলে তাকে বুঝায় সাধ্য কার। বাধ্য হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই শ্রীলংকায় এজেন্ট নিয়োগ দিলো। জাহাজ থেকে প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট পাঠানো হলো। ঠিক হলো গলে পোর্টের কাছে আসলে জাহাজ স্লো ডাউন করে ওকে আগে থেকে প্রস্তুত থাকা টাগ বোটে নামিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু শ্রীলংকার ওই স্পটে পৌঁছার তিন চার আগে থেকেই সাগর প্রচণ্ড উত্তাল। সাগর শান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখছি না। এই অবস্থা থাকলে টাগবোট জাহাজের পাশে আসা একেবারেই অসম্ভব।

আমাদের আর কাইয়ুমের ভাগ্য কিছুটা হলেও প্রসন্ন হলো। গত আগস্ট মাসের ৪ তারিখ ভোর ছয়টায় আমরা নির্দিষ্ট স্পটে এসে পৌঁছালাম। কিন্তু সাগরের দাপাদাপি আর বাতাসের নাচানাচিতে ঢেউয়ের আড়াআড়ি (Lee side) জাহাজকে এনে সকাল ৮টার সময় কাইয়ুমকে নিরাপদে টাগবোটে নামাতে পারলাম।

আমরাও কিছুদিনের জন্য ভুলে গেলাম জীবন আলী আর কাইয়ুমের কথা। কিন্তু জাহাজ ইন্ডিয়ান ওশানের পশ্চিম তীরে আসতেই আরও চারজন সাইন অফের নোটিস দিলো। সাউথ আফ্রিকায় ভিসার ঝামেলা নাই। বাংলাদেশিদের জন্য আলাদা কোনো খাতিরও নাই যা ইন্ডিয়া করে রেখেছে। লোকাল এজেন্টের লেটার অব গ্যারান্টি পেলেই সাইন অফ/অন করা যায়।

কিন্তু হেড অফিস আকারে ইংগিতে বুঝিয়ে দিলো জীবন আলীকে এবারও পাঠানো হবে না। কারণ তাকে

ছাড়াই সেইফ ম্যানিং কভার করে! কর্তাব্যক্তিদের বুঝানোর চেষ্টা করলাম সেইফ ম্যানিং কভার করলেও ইঞ্জিন রুমে কাজের পরিধি এই জনবল দিয়ে কভার করা যাচ্ছে না। কারণ জাহাজে মানুষের চেয়ে কাজ বেশি, সুযোগের চেয়ে সমস্যা বেশি। তাছাড়া ওভারডিউ কাজের জন্য পিএসসি (Port state control) ইন্সপেকশনে জাহাজ আটকে যেতে পারে। এই বিষয়টাও বিবেচনয়ায় রাখতে অনুরোধ করলাম।
তাদের কথা-বার্তায় তেমন আশার আলো দেখা গেল না। কিন্তু কয়েকদিন পর অন সাইনার ক্রুদের তালিকায় জীবন আলীর নামটা দেখে চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। শেষ পর্যন্ত এই ধারাবাহিক নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারখি জীবন আলী সাউথ আফ্রিকার ডারবানে আমাদের সাথে যোগ দিল।

জীবন আলীর জন্য জীবন এখানেও সহজ নয়। জাহাজের দোলাদোলিতে জীবন আলী খাওয়া-দাওয়া ভুলে কাৎ হয়ে পড়ে রইলো। কিন্তু আমি জানি আর বিশ্বাসও করি জীবন আলীদের সাথে জীবন যতই নির্মম ঠাট্টা-মশকরা করুক; ওরা উঠে দাঁড়াবেই। আমাদের সিস্টেম, সমাজ আর অবহেলিত জীবন যতই ওদের ল্যাং মেরে ঠ্যাং ভেঙে দিতে চাক, ওরা ততই শক্তপায়ে একদিন উঠে দাঁড়াবে।

জীবন আলীর মতো লক্ষ হাজার হাড় জিরজিরে প্রবাসী মানুষের শরীরের ভিতরে যে অপরিসীম মানসিক শক্তি আছে তাতে ভর করেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে প্রিয় বাংলাদেশ। তাদের শ্রমে-ঘামেই হাসি ফুটবে জীবন আলীর বাবা-মার মতো অযুত-নিযুত সর্বস্ব খোয়ানো বাবা-মায়ের।

এই বিশ্বাসের পেছনেন কিছু কারণ তো হাতে-নাতেই পাওয়া গেল আজ। মাত্র দুদিন আগেও ফ্লোরে গড়াগড়ি খাওয়া জীবন আলীকে আজ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখলাম ওয়ার্কিং ড্রেস পরা, ইঞ্জিন রুম থেকে ফিরছে। সালাম দিয়ে এক গাল হেসে আমাকেই জিজ্ঞেস করছে, ‘কেমন আছেন স্যার’!

ট্যাগ :
জনপ্রিয় সংবাদ

জীবন আলী

প্রকাশিত : ০২:১০:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ নভেম্বর ২০২৩

আমাদের জাহাজে সদ্য জয়েন করা এক নবীন ইঞ্জিন ক্রু। জাহাজের ভাষায় আমরা একে ‘ওয়াইপার’ (Wiper) বা ‘ফায়ারম্যান’ ( Fireman) বলি। নাটোরের এক অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেয়া জীবন আলী বাংলাদশের হাজারো অল্প শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত তরুণদেরই একজন। হত-দরিদ্র বাবা-মার ঘরে জন্ম নেয়া, সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই তরুণরা জীবনকে বুঝার আগেই জীবনের দায় মেটাতে একটা কাজ খুঁজে পেতে হন্যে হয়ে উঠে।

জীবন আলীও কারো কাছ থেকে শুনে অথবা গ্রামে ঘুরে বেড়ানো দালালের আকাশচুম্বী প্রলোভনে পড়ে

জাহাজে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু জাহাজে চাকরি করার জন্য প্রাথমিক প্রক্রিয়াটা খুবই দীর্ঘ আর জটিল। সাধারণ ক্রু হিসেবে জয়েন করার জন্যেও তাদেরকে সরকার অনুমোদিত কোনো মেরিন অ্যাকাডেমি থেকে কমপক্ষে ছয় মাসের ট্রেনিং নিতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের আর সব প্রতিষ্ঠানের মতো এই সব বেসরকারি মেরিন অ্যাকাডেমিগুলোও ট্রেনিং এর চাইতে সহজ-সরল তরুণদের স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ট্রেডিং করতেই বেশি ব্যস্ত।
কোভিড মহামরি শুরু হওয়ায় আগে আগে জীবন আলীও এক দালালের মাধ্যমে বাবার শেষ সম্বল জমিটুকু বিক্রি করে পাঁচ লাখ পনের হাজার টাকা জমা দিয়েছিল এক বেসরকারি মেরিন অ্যাকাডেমি বরাবর। ভর্তি হতে এসে দেখে তার নামে আড়াই লাখ টাকা জমা করা হয়েছে। বাকিটা দালাল মেরে দিয়েছে। এলাকায় বহু দেনদরবার করার পর দালাল আরও এক লাখ টাকা ফেরত দিয়েছে। ভাগ্য ভালো যে দালাল বেটা যুবক, ডেস্টিনি, ইউনিপে টু, বা শেয়ার বাজারের মতো পুরোটা মেরে হাওয়া হয়ে যায়নি। কিন্তু পুরো টাকা জমা না দিলে আ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়া যাবে না। এবার এক চাচার মাধ্যেমে ব্রাক থেকে দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ভর্তির ব্যবস্থা হলো।

বিক্রিযোগ্য সব কিছু শেষ করে ঋণের বোঝায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হলেও ট্রেনিং আর নেয়া হয়নি, কারণ ততদিনে কোভিডের কারণে আ্যাকাডেমি বন্ধ। থাকা খাওয়া ট্রেনিং সব ওই টাকার মধ্যেই শেষ হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র এক মাসের মাথায় জীবন আলীকেও বাড়ি ফিরতে হয়েছে অন্যান্য অনেকের মতো। বলা হয়েছে কোভিড শেষ হলে এসে যাতে সার্টিফিকেট নিয়ে যায়। এদিকে কোভিডও শেষ হয় না, জীবন আলীর সার্টিফিকেট আর অন্যান্য ডকুমেন্টও (পাসপোর্ট, সিডিসি, এসআইডি) পাওয়া হয় না। বাবা মানুষের জমিতে কাজ করে আর ইন্টার পাশ করা জীবন আলী রাজ মিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করে যা উপার্জন করেছে তা দিয়ে পাঁচজনের সংসার কীভাবে চলেছে আর কীভাবে ব্র্যাকের টাকার কিস্তি পরিশোধ করেছে হয়তো আমরা অনেকেই অনুমান করতে পারছি। তাই সেই বিশদ বর্ণনা আপাতত তোলাই থাকুক।

গত বছর জুন মাসে ওর সিডিসি বা সিম্যান বুক ইস্যু হয়। সিডিসি, পাসপোর্ট, এসআইডি, মেডিকেল ফিটনেস সার্টিফিকেট আর নাবিকদের জন্য ম্যান্ডেটরি প্রাথমিক ছয়টা Ancillary course সার্টিফিকেট পেতে লেগে যায় আরও প্রায় এক লাখ টাকা। এই টাকা কিভাবে যোগাড় হয়েছে সেটা জানার সাহস আমার হয়নি।

সব ডকুমেন্ট হাতে পাওয়ার পর জীবন আলীও স্বপ্ন দেখতে থাকে একদিন জাহাজে যাওয়ার ডাক আসবে। (উল্লেখ্য যে ট্রেনিং অ্যাকাডেমিগুলোই এসব ক্রুকে জাহাজে চাকরি দেয়ার ব্যাপারে কমিডেট থাকে) কিন্তু নাটোর থেকে চট্টগ্রামে এসে আ্যাকাডেমির সাহেবদেরকে অনুরোধ করার জন্য গাড়ি ভাড়াটা যোগাড় করাও হয়ে উঠে না জীবন আলীর, আর তাই কোন জাহাজের ক্রু তালিকায় তার নামও উঠে না।

এ বছর এপ্রিল মাসে জীবন আলী একটু আলোর দেখা পায় যখন সে জানতে পারে তাকে একটা জাহাজের জন্য সিলেক্ট করা হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগাদের সাথে ভাগ্যও মনে হয় মাঝে মাঝে নির্মম নাটক করে। জীবন আলীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটল।

এই অশ্রুতপূর্ব, অদৃষ্টপূর্ব ঘটনা আমার দীর্ঘ নাবিক জীবনে আমি দেখিনি, শুনিওনি, সেটা বলার জন্যই এই দীর্ঘ গৌড়চন্দ্রিকা।

জয়েনিং ক্রু লিস্ট যখন আমার হাতে আসলো দেখি সেই তালিকায় জীবন আলী আর কাবিল হোসেন; এই দুটি নাম আছে। অর্থাৎ জীবন আলী আর আমি একই জাহাজে যাচ্ছি। একটু অপ্রচলিত নাম বলেই ওই নামগুলোর দিকে চোখ গিয়েছিল সে সময়। এর বেশি গুরুত্ব পাওয়ার মতো কিছুই ছিল না। যে ৭ জন আমরা জয়েন করতে যাচ্ছিলাম তার মধ্যে শুধু চিফ ইঞ্জিনিয়ার আর থার্ড ইঞ্জিয়ার আমার পূর্ব পরিচিত।আর কাউকেই আমি তখন চিনতাম না।

জীবন আলী

বাংলাদেশের পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন লেখক আলমগীর কবির। লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া ছবি।

এপ্রিল মাসের ৬ তারিখে আমার আগেই সবাই বিমানবন্দরে উপস্থিত। আমিও গিয়ে সবার সাথে পরিচিত হলাম। সবার ট্রাভেল ডকুমেন্টস আর সিম্যান ডকুমেন্ট এর কথা জিজ্ঞেস করতেই বোসান (হেড অব ডেক ক্রু) বলল, স্যার, ম্যানিং এজেন্সি জীবন আলীর পাসপোর্টের জায়গায় অন্য আরেকজনের পাসপোর্ট আমাকে অন্যান্য ডকুমেন্টের সাথে একই প্যাকেটে দিয়ে দিয়েছে। এখানে এসে প্যাকেট খুলে দেখি জীবন আলীর পাসপোর্টের বদলে আরেক জনের পাসপোর্ট আছে প্যাকেটে!

এই অদ্ভুতুরে কাণ্ডকীর্তি আগে কখনো দেখিনি। (এখানে বলে রাখা ভালো যে সিম্যানদের জয়েনিং কনফার্ম হলে কিছু কিছু ম্যানিং কোম্পানি দু-একটা গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ওদের কাছে রেখে দেয় যাতে সিম্যান অন্য কোনো কোম্পানিতে চলে যেতে না পারে। জীবন আলী যে কোম্পানিতে ট্রেনিং করেছে, ম্যানিং এজেন্সিও সেই একই কোম্পানির। তাই ওর প্রায় সব ডকুমেন্টস ওদের কাছেই ছিল)। কিছুটা সময় স্তম্ভিত হয়ে থেকে ফোন করলাম ম্যানিং এজেন্সি অফিসে। এটা যে বড়সড় কোনো ভুল তাদের কথায় সেরকম মনেই হলো না।

বলল, ছোট একটা ভুল হয়ে গেছে স্যার। আপনি ভুল পাসপোর্টটা সহ ওকে বাড়িতে চলে যেতে বলেন, আমরা পরবর্তী সুবিধাজনক সিডিউলে ওকে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি। বুঝতে পারলাম জীবন আলীর আর ব্রাজিল যাওয়া হচ্ছে না। পরবর্তী সিডিউল স্রেফ ছেলে ভোলানো সান্তনা। কারণ আমাদের যাওয়া আর সাইন অফ ক্রুদের ফিরে আসার জন্য সময় আছে মাত্র চারদিন।

জীবন আলী জয়েন করলে আবদুল কাইয়ুমের দেশে আসার কথা, সেটাও অনিশ্চিত হয়ে গেল অনিশ্চিত সময়ের জন্য। অথচ কাইয়ুমের ততদিনে ৯ মাসের বেশি হয়ে গেছে জাহাজে। নাবিকদের ভ্রমনের জন্য ভিসা না লাগলেও বাংলাদেশি ক্রুদের জন্য অনেক দেশই লেটার অব গ্যারান্টি ইস্যু করে না। কারণ আমাদের জাতিগত ইতিহাস এতই সমৃদ্ধ যে বাংলাদেশের কথা শুনলেই অনেক দেশ চ্যাপ্টার ক্লোজ করে বসে থাকে।

জাহাজ কোন দেশের কোন পোর্টে যাবে সেটা আগে থেকে জানার সুযোগ নেই। জানা গেলেও সব দেশে

বাংলাদেশের ক্রু চেঞ্জ করায় অসংখ্য বাধা নিষেধ আছে। অর্থাৎ Convenient Port না পেলে ক্রু চেঞ্জ করা যায় না। জীবন আলীর বিষয়টাও ধামাচাপা পড়ে গেল সম্ভাবনা আর গাফিলতির লাল ফিতায়। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো আবদুল কাইয়ুমকে নিয়ে। তার রিলিভার যেহেতু আসতে পারে নাই তাই কাইয়ুমেরও

সাইন অফ হয়নি ব্রাজিল থেকে।
জীবন আলী

জাহাজে সহকর্মীদের সঙ্গে আলমগীর কবির। লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া ছবি।

মাঝে দুই মাসের বেশি পার হয়ে গেল সাইন অন/অফ করার মতো কোনো পোর্ট পাওয়া গেল না। অনেকটা মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতোই অপারেশন্স ডিপার্টমেন্ট জানালো জাহাজের নেক্সট পোর্ট সিংগাপুর হয়ে চায়নার চিংদাও (Qingdao)। আবদুল কাইয়ুম আর ডেক ক্যাডেট সাইন অফ লেটার দিল। সিংগাপুর যেতে যেতে দুইজনেরই ১২ মাসের বেশি ভয়েজ হয়ে যাবে।

সিংগাপুরে বাংলাদেশি ক্রুদের সাইন অন/অফে ভিসা নিতে হয়। এজেন্টের মাধ্যমে ভিসার আবেদন করলে প্রায় সব ক্রুর জন্যই ভিসা পাওয়া যায়। সিংগাপুরে পৌঁছার আগেই ডেক ক্যাডেটের ভিসা কপি জাহাজে চলে আসলেও কাইয়ুমের ভিসার কোনো খবর নাই।

এদিকে কাইয়ুম দিনে তিন চার বার এসে জানতে চায় তার ভিসার কোনো খবর আছে কিনা। অনলাইনে তার ভিসা এপ্লিকেশন পেন্ডিং দেখাচ্ছে। সিংগাপুর পৌঁছার দুই দিন আগে ম্যানিং অফিসে ফোন দিলাম কাইয়ুমের ভিসার ব্যাপারে। যা জানলাম তাতে মেজাজ ধরে রাখা খুবই কঠিন হয়ে গেল।

ম্যানিং অফিসে রাখা কাইয়ুমের পুরাতন পাসপোর্টের নম্বর দিয়েই ভিসার এপ্লিকেশন করা হয়েছে। অথচ আমি যে ক্রু লিস্ট ইমিগ্রেশনে জাহাজ থেকে পাঠিয়েছি তাতে নতুন পাসপোর্টের তথ্য। পাঁচ বছর মেয়াদি মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট বদলিয়ে কাইয়ুম ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্ট করে জাহাজে এসেছে। পুরোনো পাসপোর্ট ম্যানিং এজেন্সির অফিসেই ছিল। আর আহাম্মকের দল সেই পাসপোর্টের তথ্য দিয়েই ভিসা আবেদন করেছে।

আমাকে আবার উলটো রিকোয়েস্ট করলো আমি যাতে কাইয়ুমের পুরোনো পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে আরেকটা ক্রু লিস্ট ডিক্লেয়ার করি!

আমি শুধু বললাম, আমাকে কি তোমার কাছে পাগল বা গাঁজাখোর বলে মনে হয়??

-স্যরি স্যার, আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না বলেই এই রিকোস্টটা করলাম।

নিজেকে কোনো রকম সংযত করে বললাম, যা বলেছ, তা আর ভবিষ্যতে কখনো মুখেও আনবে না। একজন ক্রুর জন্য আমি গোটা বাংলাদেশি ক্রু আর আমার জাহাজের ২২ জন ক্রু কে সারাজীবনের জন্য সিংগাপুরে ব্লাক লিস্টেড করতে পারি না।

-স্যরি স্যার।

কিন্তু শুধু সরি বলাতেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। অন সাইনার (On Signer) ডেক ক্যাডেট আর জীবন আলীর ভিসা হলেও জীবন আলী আসতে পারলো না কারণ তার রিলিভার কাইয়ুমের ভিসা এপ্লিকেশন রিজেক্ট হয়েছে।

এবার কাইয়ুম এসে উৎপাত শুরু করল। কান্নাকাটি চেঁচামেচি করে ডিউটিতে যাওয়া বন্ধ করে দিল। ওকে বুঝালাম, ওর ভিসা না হওয়ার জন্য আমরা দায়ী নই। ভুলটা করেছে ম্যানিং এজেন্সি, তুমি জাহাজে অশান্তি করলে তো কারও কোনো লাভ হবে না।

চায়নার চিংদাওতে তোমাকে নামানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করব। ভালো ছেলে, কথা শুনলো। একদিন পর কাজেও যোগ দিল। কথা বললাম (জাহাজ মালিকের) হেড অফিসের সাথে। ওরা খবর নিয়ে জানালো চায়নার ভিসা আবেদন অনেক দিন আগে করতে হয়। তাছাড়া এত আবেদন পেন্ডিং হয়ে আছে যে আবেদন করলেও এক মাসের আগে কিছুই জানা যাবে না।

অনন্যোপায় হয়ে চায়নার এজেন্টের সাথে কথা বললাম। এজেন্ট জানালো ভিসা ছাড়াও সাইন অফসম্ভব। তবে সেটা লোকাল এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি চায়নার বাইরে যে কোনো দেশে চলে যেতে হবে। চায়নার ভিতরে কোনো কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে হলে তাকে ভিসা নিতেই হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, চিংদাও এয়ারপোর্ট থেকে কোন ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট নাই। ভিসা এপ্লিকেশন প্রসেস করতে যে সময় লাগে তার অনেক আগেই তুমি পোর্ট ছেড়ে চলে যাবে। স্যরি ক্যাপ্টেন। এখানেও স্যরি। কিন্ত আমি শুধু স্যরি বলে কাইয়ুমকে কিছু বুঝাতে পারছি না। ২১-২২ বছরের বাচ্চা একটা ছেলে। ১৩ মাস এক নাগাড়ে জাহাজে। এটাই ওর প্রথম ভয়েজ। যুক্তি আর বাস্তবতা বুঝার মতো বয়স বা মানসিক অবস্থা কোনটাই ওর নাই।

ওদিকে জীবন আলী সব খুইয়ে বসে আছে জাহাজে আসার জন্য এদিকে আবদুল কাইয়ুম সব কিছু দিয়ে হলেও জাহাজ থেকে নেমে যেতে চাইছে।

চায়নার পালা শেষ করে জাহাজ আবার রওনা হলো সিংগাপুরের দিকে। এবার কাইয়ুম সহ আরও তিনজন সাইন অফ রিকোয়েস্ট লেটার দিল। যথারীতি সবার জন্যই সিংগাপুরের ভিসা আবেদন করা হলো। যারা আসবে এবং যাবে সবার ভিসা হলেও কাইয়ুমের ভিসা এপ্লিকেশন আবারও রিজেক্ট হলো। যদিও এবার নতুন পাসপোর্ট দিয়ে জাহাজ থেকেই সব তথ্য দেয়া হয়েছিল। কারণ হিসাবে জানা গেল মাত্র একমাস আগেই ভিন্ন পাসপোর্ট নম্বরে এপ্লিকেশন করে জাহাজে থেকেই নতুন পাসপোর্ট কিভাবে পেল। এটা সন্দেহজনক এবং সরাসরি রিজেক্টেড।

জীবন আলী

কাজের ফাঁকে সেলফিতে লেখক। লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে নেওয়া ছবি।

বাকি তিনজন চলে গেল, দেশ থেকে তিনজন জাহাজেও আসলো। কিন্তু কাইয়ুমের যাওয়া হলো না আর জীবন আলীরও আসা হলো না। যদিও জীবন আলীর ভিসা প্রথমবারই হয়েছিল। কাইয়ুমকে সান্তনা বা আশা দেয়ার মতো আমার হাতে কিছুই থাকলো না। কারণ জাহাজের ডেস্টিনেশন ইন্ডিয়ার গুজরাট। গুজরাট থেকে সাইন অফ তো দূরের কথা বাংলাদেশিদের হাঁটার জন্য বাইরে যাওয়ারও অনুমতি নাই। এমনকি মাত্র ত্রিশ দিন মেয়াদি লোকাল সিমকার্ড কেনাতেও বাংলাদেশিদের জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা।

ওরা আমাদের প্রাণের বন্ধু না? নিষেধাজ্ঞাতো ওরাই দেবে, তাই না?

সিংগাপুরে জাহাজ অবস্থান করে সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা। কারণ জ্বালানি তেল বা বাংকার নেয়ার জন্যই মূলত সিংগাপুরে থামা হয়। এর মধ্যেই সিংগাপুর ইমিগ্রেশন বরাবর পূর্বাপর সব ঘটনা জানিয়ে মানবিক কারণে জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে কাইয়ুমের ভিসা মঞ্জুর করার জন্য বিশাল সাইজের একটা এপ্লিকেশন পাঠালাম। পরামর্শটা অবশ্য সিংগাপুর এজেন্টই দিয়েছিল। কিন্তু সময়ের অভাবে সেই এপ্লিকেশনের ভাগ্য জানার সুযোগ ছিল না। মজার বিষয় হলো, সিংগাপুর থেকে সেইল করার দুদিন পর এজেন্ট মেইল দিয়ে জানালো ক্যাপ্টেনের এপ্লিকেশন ওরা বিবেচনা করেছে, কাইয়ুমকে ভিসা দিতে সম্মত হয়েছে যদি ইতিমধ্যে জাহাজ সেইল করে চলে না গিয়ে থাকে।

ভাগ্যকে দোষারোপ করা ছাড়া আমাদের করার আর কিছুই ছিল না। কাইয়ুম চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে সরাসরি বলে দিল, সে পানিতে ঝাঁপ দেবে আর এর জন্য আমরাই দায়ী থাকব।

কাজতো অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছে, পাগলামিও শুরু করলো যথেচ্ছ। কাইয়ুমের হুমকিকে পাগলামির বহিঃপ্রকাশ মনে হতে পারে। কিন্তু ধৈর্য হারা সিম্যানদের পক্ষে এসব শুধু কথার কথা নয়। অবাস্তবও নয়। টপ আর্জেন্ট ক্যাটাগরিতে মেইল দিলাম সব পক্ষকে। এবং পরিষ্কার করে বলে দিলাম ওর পক্ষ থেকে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জাহাজের মাস্টার বা কোনো ক্রু কোনোভাবেই দায়ী থাকবে না। আপনাদের ঠেলা আপনারা সামলান।

পরামর্শ হিসাবে বললাম, জাহাজ যেহেতু শ্রীলংকার পাশ দিয়েই যাবে সুতরাং গলে তে (Galle) ওকে

সহজেই নামানো যায়। এটাও জানালাম কাইয়ুমকে রিলিভার ছাড়া নামিয়ে নিলেও সেইফ ম্যানিং এর কোনো সমস্যা হবে না। (একটা জাহাজ সেইফলি চালানোর জন্য মোট কতজন সার্টিফাইড ক্রু লাগবে, তার

জন্য একটা সার্টিফিকেট লাগে, যাকে সেইফ ম্যানিং সার্টিফিকেট বলে) ইন্ডিয়ার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।
এবার সবাই নড়েচড়ে বসলো। কর্তাব্যক্তিরা সবাই সরাসরি ওকেই ফোন করতে লাগলো। তেলতেলে কথাবার্তাও অনেক শোনাল। কিন্তু সহজ সরল মানুষ ক্ষেপে গেলে তাকে বুঝায় সাধ্য কার। বাধ্য হয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই শ্রীলংকায় এজেন্ট নিয়োগ দিলো। জাহাজ থেকে প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট পাঠানো হলো। ঠিক হলো গলে পোর্টের কাছে আসলে জাহাজ স্লো ডাউন করে ওকে আগে থেকে প্রস্তুত থাকা টাগ বোটে নামিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু শ্রীলংকার ওই স্পটে পৌঁছার তিন চার আগে থেকেই সাগর প্রচণ্ড উত্তাল। সাগর শান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখছি না। এই অবস্থা থাকলে টাগবোট জাহাজের পাশে আসা একেবারেই অসম্ভব।

আমাদের আর কাইয়ুমের ভাগ্য কিছুটা হলেও প্রসন্ন হলো। গত আগস্ট মাসের ৪ তারিখ ভোর ছয়টায় আমরা নির্দিষ্ট স্পটে এসে পৌঁছালাম। কিন্তু সাগরের দাপাদাপি আর বাতাসের নাচানাচিতে ঢেউয়ের আড়াআড়ি (Lee side) জাহাজকে এনে সকাল ৮টার সময় কাইয়ুমকে নিরাপদে টাগবোটে নামাতে পারলাম।

আমরাও কিছুদিনের জন্য ভুলে গেলাম জীবন আলী আর কাইয়ুমের কথা। কিন্তু জাহাজ ইন্ডিয়ান ওশানের পশ্চিম তীরে আসতেই আরও চারজন সাইন অফের নোটিস দিলো। সাউথ আফ্রিকায় ভিসার ঝামেলা নাই। বাংলাদেশিদের জন্য আলাদা কোনো খাতিরও নাই যা ইন্ডিয়া করে রেখেছে। লোকাল এজেন্টের লেটার অব গ্যারান্টি পেলেই সাইন অফ/অন করা যায়।

কিন্তু হেড অফিস আকারে ইংগিতে বুঝিয়ে দিলো জীবন আলীকে এবারও পাঠানো হবে না। কারণ তাকে

ছাড়াই সেইফ ম্যানিং কভার করে! কর্তাব্যক্তিদের বুঝানোর চেষ্টা করলাম সেইফ ম্যানিং কভার করলেও ইঞ্জিন রুমে কাজের পরিধি এই জনবল দিয়ে কভার করা যাচ্ছে না। কারণ জাহাজে মানুষের চেয়ে কাজ বেশি, সুযোগের চেয়ে সমস্যা বেশি। তাছাড়া ওভারডিউ কাজের জন্য পিএসসি (Port state control) ইন্সপেকশনে জাহাজ আটকে যেতে পারে। এই বিষয়টাও বিবেচনয়ায় রাখতে অনুরোধ করলাম।
তাদের কথা-বার্তায় তেমন আশার আলো দেখা গেল না। কিন্তু কয়েকদিন পর অন সাইনার ক্রুদের তালিকায় জীবন আলীর নামটা দেখে চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। শেষ পর্যন্ত এই ধারাবাহিক নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারখি জীবন আলী সাউথ আফ্রিকার ডারবানে আমাদের সাথে যোগ দিল।

জীবন আলীর জন্য জীবন এখানেও সহজ নয়। জাহাজের দোলাদোলিতে জীবন আলী খাওয়া-দাওয়া ভুলে কাৎ হয়ে পড়ে রইলো। কিন্তু আমি জানি আর বিশ্বাসও করি জীবন আলীদের সাথে জীবন যতই নির্মম ঠাট্টা-মশকরা করুক; ওরা উঠে দাঁড়াবেই। আমাদের সিস্টেম, সমাজ আর অবহেলিত জীবন যতই ওদের ল্যাং মেরে ঠ্যাং ভেঙে দিতে চাক, ওরা ততই শক্তপায়ে একদিন উঠে দাঁড়াবে।

জীবন আলীর মতো লক্ষ হাজার হাড় জিরজিরে প্রবাসী মানুষের শরীরের ভিতরে যে অপরিসীম মানসিক শক্তি আছে তাতে ভর করেই মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে প্রিয় বাংলাদেশ। তাদের শ্রমে-ঘামেই হাসি ফুটবে জীবন আলীর বাবা-মার মতো অযুত-নিযুত সর্বস্ব খোয়ানো বাবা-মায়ের।

এই বিশ্বাসের পেছনেন কিছু কারণ তো হাতে-নাতেই পাওয়া গেল আজ। মাত্র দুদিন আগেও ফ্লোরে গড়াগড়ি খাওয়া জীবন আলীকে আজ সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখলাম ওয়ার্কিং ড্রেস পরা, ইঞ্জিন রুম থেকে ফিরছে। সালাম দিয়ে এক গাল হেসে আমাকেই জিজ্ঞেস করছে, ‘কেমন আছেন স্যার’!